Other

ইলিশ মাছের শারীরিক গঠন

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু আমাদের খাদ্যতালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়, বরং এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সুস্বাদু মাছটি তার অনন্য স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু এর পিছনে রয়েছে একটি অত্যন্ত জটিল ও আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা ইলিশ মাছের শারীরিক গঠন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা এই মাছটিকে অন্যান্য প্রজাতি থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে।

ইলিশ মাছ (বৈজ্ঞানিক নাম: Tenualosa ilisha) ক্লুপিডে পরিবারের অন্তর্গত। এটি মূলত নদী ও সমুদ্রের মোহনা অঞ্চলে বসবাস করে এবং প্রজননের জন্য মিঠা পানিতে অভিবাসন করে। এই অনন্য জীবনচক্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইলিশের শরীর বিবর্তিত হয়েছে, যা তাদেরকে বিভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

আসুন এখন আমরা ইলিশ মাছের শারীরিক গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।

১. বাহ্যিক গঠন

১.১ আকার ও আকৃতি

ইলিশ মাছের শরীর সুডৌল ও চ্যাপ্টা, যা তাদের দ্রুত সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। সাধারণত, প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ মাছের দৈর্ঘ্য ৩০-৫০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৮০০ গ্রাম থেকে ৩ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। তবে, বিরল ক্ষেত্রে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা ইলিশও দেখা যায়।

ইলিশের শরীরের আকৃতি:

  • মাথা: ছোট ও সুচালো
  • শরীর: চ্যাপ্টা ও উভয় প্রান্তে ক্রমশ সরু
  • পেট: ধারালো কিল আকৃতির

এই বিশেষ আকৃতি ইলিশকে জলস্রোতের বিরুদ্ধে সহজে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে, যা তাদের দীর্ঘ অভিবাসন পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১.২ রং ও চামড়া

ইলিশ মাছের গায়ের রং অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময়:

  • পিঠের দিক: গাঢ় নীলাভ-সবুজ
  • পার্শ্বদেশ: রূপালি
  • পেটের দিক: সাদাটে

এই রঙের বিন্যাস ইলিশকে জলের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। উপর থেকে দেখলে, গাঢ় রঙের কারণে ইলিশকে জলের গভীরতার সাথে মিশে যেতে দেখা যায়। আবার নিচ থেকে দেখলে, সাদাটে পেটের অংশ আকাশের আলোর সাথে মিশে যায়, যা শিকারীদের থেকে তাদের রক্ষা করে।

ইলিশের চামড়া পাতলা ও নরম, যা সহজেই খসে যায়। এটি ঘন আঁশে ঢাকা থাকে, যা মাছটিকে পিচ্ছিল করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্য ইলিশকে শিকারী থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।

১.৩ আঁশ

ইলিশ মাছের গায়ে অসংখ্য ছোট ছোট আঁশ থাকে, যা সাইক্লয়েড প্রকৃতির। এই আঁশগুলো:

  • সংখ্যা: প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে প্রায় ৭০-৮০টি
  • আকার: ব্যাস প্রায় ০.৫-১ মিলিমিটার
  • গঠন: বৃত্তাকার, পাতলা ও স্বচ্ছ

আঁশের কাজ:

  1. শরীর রক্ষা: বাহ্যিক আঘাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে
  2. জল নিয়ন্ত্রণ: শরীরে অতিরিক্ত পানি প্রবেশ রোধ করে
  3. গতি সহায়ক: সাঁতার কাটার সময় জলের প্রতিরোধ কমায়

ইলিশের এই সূক্ষ্ম আঁশ তাদের খাওয়ার সময় একটু অসুবিধা সৃষ্টি করলেও, এটি তাদের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২. অভ্যন্তরীণ গঠন

২.১ কঙ্কাল কাঠামো

ইলিশ মাছের কঙ্কাল কাঠামো জটিল ও সুসংগঠিত। এটি মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত:

  1. মাথার অস্থি:
    • খুলি: মস্তিষ্ক ও জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোকে রক্ষা করে
    • চোয়াল: উপরের চোয়াল (ম্যাক্সিলা) ও নিচের চোয়াল (ম্যান্ডিবল)
    • কানকোর অস্থি: শ্বাসপ্রশ্বাসে সাহায্য করে
  2. মেরুদণ্ড:
    • সংখ্যা: ৪৬-৪৭টি কশেরুকা
    • কাজ: শরীরকে কাঠামো প্রদান ও স্নায়ুতন্ত্রকে রক্ষা করে
  3. পাখনার অস্থি:
    • পার্শ্ব পাখনা: ৭-৮টি অস্থি
    • পৃষ্ঠ পাখনা: ১৮-২০টি অস্থি
    • পায়ু পাখনা: ১৯-২২টি অস্থি

ইলিশের কঙ্কাল কাঠামো হালকা কিন্তু মজবুত, যা তাদের দ্রুত ও দক্ষতার সাথে সাঁতার কাটতে সহায়তা করে।

২.২ পেশী কাঠামো

ইলিশ মাছের পেশী কাঠামো জটিল ও সুসমন্বিত। এটি মূলত দুই ধরনের পেশী দিয়ে গঠিত:

  1. লাল পেশী:
    • অবস্থান: শরীরের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে
    • বৈশিষ্ট্য: অক্সিজেন-সমৃদ্ধ, ধীর সংকোচনশীল
    • কাজ: দীর্ঘ সময় ধরে সাঁতার কাটার জন্য শক্তি সরবরাহ করে
  2. সাদা পেশী:
    • অবস্থান: পার্শ্বীয় রেখার কাছাকাছি
    • বৈশিষ্ট্য: কম অক্সিজেন প্রয়োজন, দ্রুত সংকোচনশীল
    • কাজ: হঠাৎ দ্রুত গতিতে সাঁতার কাটার জন্য ব্যবহৃত হয়

ইলিশের এই দুই ধরনের পেশী তাদেরকে দীর্ঘ অভিবাসন পথে ধীরে ধীরে সাঁতার কাটতে এবং প্রয়োজনে দ্রুত গতিতে পালাতে সাহায্য করে।

২.৩ পাকস্থলী ও পরিপাক তন্ত্র

ইলিশ মাছের পাকস্থলী ও পরিপাক তন্ত্র তাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ:

  1. মুখ গহ্বর:
    • ছোট ও উপরমুখী
    • দাঁত: খুব ছোট বা অনুপস্থিত
  2. গলবিল:
    • সংখ্যা: ১০০-২৫০টি
    • কাজ: প্লাংকটন ধরার জন্য ফিল্টার হিসেবে কাজ করে
  3. পাকস্থলী:
    • আকার: মাঝারি
    • পাকস্থলীর পিলোরিক সিকা: ১২-৩০টি
    • কাজ: খাদ্য হজমে সাহায্য করে
  4. অন্ত্র:
    • দৈর্ঘ্য: শরীরের দৈর্ঘ্যের প্রায় ২.৫ গুণ
    • কাজ: খাদ্য শোষণ ও বর্জ্য নিষ্কাশন

ইলিশের এই বিশেষ পরিপাক তন্ত্র তাদেরকে প্লাংকটন, ছোট মাছ ও অন্যান্য জলজ জীব সহজে খেতে ও হজম করতে সাহায্য করে।

৩. বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ

৩.১ পাখনা

ইলিশ মাছের পাখনাগুলো তাদের সাঁতার কাটা ও ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইলিশের পাঁচ ধরনের পাখনা রয়েছে:

  1. পৃষ্ঠ পাখনা:
    • অবস্থান: পিঠের মাঝামাঝি
    • সংখ্যা: ১টি
    • রশ্মি সংখ্যা: ১৮-২১টি
    • কাজ: ভারসাম্য বজায় রাখা ও দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে
  2. বুক পাখনা:
    • অবস্থান: বুকের দুই পাশে
    • সংখ্যা: ২টি
    • রশ্মি সংখ্যা: প্রতিটিতে ১৫-১৭টি
    • কাজ: গতি নিয়ন্ত্রণ ও স্থির থাকতে সাহায্য করে
  3. তলপেটের পাখনা:
    • অবস্থান: পেটের নিচের দিকে
    • সংখ্যা: ২টি
    • রশ্মি সংখ্যা: প্রতিটিতে ৭-৮টি
    • কাজ: ভারসাম্য বজায় রাখা ও উল্লম্ব গতি নিয়ন্ত্রণ
  4. পায়ু পাখনা:
    • অবস্থান: পায়ুর কাছে, পেছনের দিকে
    • সংখ্যা: ১টি
    • রশ্মি সংখ্যা: ১৯-২২টি
    • কাজ: গতি নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
  5. লেজ পাখনা:
    • অবস্থান: শরীরের শেষ প্রান্তে
    • আকৃতি: দ্বিখণ্ডিত (ফর্ক আকৃতির)
    • কাজ: প্রধান চালক হিসেবে কাজ করে, গতি ও দিক নির্ধারণ করে

ইলিশের এই পাখনাগুলো একসাথে কাজ করে তাদেরকে জলস্রোতের বিপরীতে দক্ষতার সাথে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। বিশেষ করে লেজ পাখনার দ্বিখণ্ডিত আকৃতি তাদেরকে দ্রুত গতিতে সাঁতার কাটতে ও হঠাৎ দিক পরিবর্তন করতে সক্ষম করে।

৩.২ ফুলকা

ইলিশ মাছের ফুলকা তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি জল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশনের কাজ করে।

ফুলকার বৈশিষ্ট্য:

  • সংখ্যা: ৪ জোড়া
  • অবস্থান: মাথার দুই পাশে
  • রং: গাঢ় লাল (রক্তের উপস্থিতির কারণে)
  • গঠন: পাতলা, পাখনার মতো কাঠামো

ফুলকার কার্যপ্রণালী:

  1. ইলিশ মুখ দিয়ে জল গ্রহণ করে
  2. জল ফুলকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়
  3. ফুলকার পাতলা পর্দায় থাকা রক্তকণিকা জল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে
  4. অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত শরীরে প্রবাহিত হয়
  5. কার্বন ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ রক্ত থেকে CO₂ জলে মিশে যায়
  6. ব্যবহৃত জল ফুলকার পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়

ইলিশের ফুলকা অত্যন্ত দক্ষ, যা তাদেরকে কম অক্সিজেন সমৃদ্ধ জলেও টিকে থাকতে সাহায্য করে। এটি তাদের নদী থেকে সমুদ্রে এবং সমুদ্র থেকে নদীতে যাতায়াতের সময় বিভিন্ন ধরনের জলে অভিযোজনে সহায়তা করে।

৩.৩ চোখ

ইলিশ মাছের চোখ তাদের জলের নিচে দৃষ্টিশক্তির জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত:

  • আকার: বড় ও গোলাকার
  • অবস্থান: মাথার দুই পাশে, সামনের দিকে
  • লেন্স: গোলাকার ও স্থির (মানুষের মতო ফোকাস পরিবর্তন করতে পারে না)
  • রেটিনা: রড ও কোন সেল সমৃদ্ধ, যা কম আলোতেও দেখতে সাহায্য করে

চোখের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  1. প্রশস্ত দৃষ্টিসীমা: ইলিশের চোখ প্রায় ১৭০ ডিগ্রি পর্যন্ত দেখতে পারে, যা তাদেরকে শিকারী ও শিকার উভয়কেই সহজে দেখতে সাহায্য করে।
  2. কম আলোতে দৃষ্টি: ইলিশের চোখে প্রচুর রড সেল থাকে, যা তাদেরকে অন্ধকার ও ঘোলা পানিতেও দেখতে সাহায্য করে।
  3. রঙ দেখার ক্ষমতা: ইলিশের চোখে কোন সেল থাকে, যা তাদেরকে রঙ দেখতে সাহায্য করে। এটি তাদেরকে খাদ্য ও শিকারী সনাক্ত করতে সহায়তা করে।

ইলিশের এই বিশেষ চোখ তাদেরকে জলের নিচে দক্ষতার সাথে চলাফেরা করতে, খাবার খুঁজতে এবং শিকারী এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে।

৩.৪ পার্শ্বরেখা

পার্শ্বরেখা ইলিশ মাছের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবেদন অঙ্গ:

  • অবস্থান: শরীরের দুই পাশে, মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত
  • গঠন: ছিদ্রযুক্ত স্কেলের সমন্বয়ে তৈরি একটি রেখা
  • সংবেদনশীল কোষ: নিউরোমাস্ট নামক বিশেষ কোষ দ্বারা আবৃত

পার্শ্বরেখার কাজ:

  1. জলের কম্পন অনুভব: পার্শ্বরেখা জলের সূক্ষ্ম কম্পন অনুভব করতে পারে, যা ইলিশকে অন্য মাছ বা বস্তুর উপস্থিতি টের পেতে সাহায্য করে।
  2. দিক নির্ণয়: জলের প্রবাহের দিক ও গতি অনুভব করে ইলিশ নিজের অবস্থান ও দিক নির্ণয় করতে পারে।
  3. গভীরতা অনুভব: জলের চাপের পরিবর্তন অনুভব করে ইলিশ নিজের গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারে।
  4. তাপমাত্রা পরিবর্তন অনুভব: জলের তাপমাত্রার পরিবর্তন অনুভব করে ইলিশ উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পায়।

পার্শ্বরেখা ইলিশকে জলের নিচে “ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়” হিসেবে কাজ করে, যা তাদেরকে নিরাপদে চলাফেরা করতে ও শিকারী এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে।

৪. প্রজনন অঙ্গ

ইলিশ মাছের প্রজনন অঙ্গ তাদের জীবনচক্রের সাথে সম্পর্কিত ও বিশেষভাবে অভিযোজিত:

৪.১ পুরুষ ইলিশ

  1. শুক্রাশয়:
    • সংখ্যা: ২টি
    • অবস্থান: শরীরের পেছনের দিকে, পাকস্থলীর পাশে
    • আকার: প্রজনন মৌসুমে বড় হয়ে যায়
    • কাজ: শুক্রাণু উৎপাদন ও সংরক্ষণ
  2. শুক্রনালী:
    • শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু বের করার পথ
    • প্রজনন মৌসুমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে

৪.২ স্ত্রী ইলিশ

  1. ডিম্বাশয়:
    • সংখ্যা: ২টি
    • অবস্থান: শরীরের পেছনের দিকে, পাকস্থলীর পাশে
    • আকার: প্রজনন মৌসুমে বিশাল আকার ধারণ করে
    • কাজ: ডিম উৎপাদন ও সংরক্ষণ
  2. ডিম্বনালী:
    • ডিম্বাশয় থেকে ডিম বের করার পথ
    • প্রজনন মৌসুমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে

ইলিশের প্রজনন অঙ্গের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  • উচ্চ উৎপাদনশীলতা: একটি স্ত্রী ইলিশ প্রায় ১০-১৫ লাখ ডিম পাড়তে পারে
  • মৌসুমি পরিবর্তন: প্রজনন মৌসুমে প্রজনন অঙ্গগুলি বড় হয়ে যায় ও অধিক সক্রিয় হয়
  • বাহ্যিক নিষেচন: ইলিশ জলের মধ্যে ডিম ও শুক্রাণু ছাড়ে, যেখানে বাহ্যিক নিষেচন ঘটে

ইলিশের এই বিশেষ প্রজনন ব্যবস্থা তাদের প্রজাতির টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

৫. রক্ত সংবহন তন্ত্র

ইলিশ মাছের রক্ত সংবহন তন্ত্র তাদের শরীরে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহের জন্য দায়ী। এটি একটি বন্ধ সংবহন তন্ত্র, যেখানে রক্ত সবসময় রক্তনালীর মধ্যে থাকে।

৫.১ হৃৎপিণ্ড

ইলিশ মাছের হৃৎপিণ্ড তাদের রক্ত সংবহন তন্ত্রের কেন্দ্রীয় অঙ্গ:

  • অবস্থান: বুক ও গলার মাঝামাঝি, ফুলকার পিছনে
  • আকার: ছোট, প্রায় মটর দানার মতো
  • কক্ষ সংখ্যা: ৪টি (২টি অলিন্দ ও ২টি নিলয়)
  • কাজ: শরীরে রক্ত সঞ্চালন

হৃৎপিণ্ডের কার্যপ্রণালী:

  1. ভেনাস সাইনাস অক্সিজেন-বিহীন রক্ত গ্রহণ করে
  2. রক্ত ডান অলিন্দে প্রবেশ করে
  3. ডান নিলয় রক্তকে ফুলকায় পাঠায়
  4. ফুলকা থেকে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত বাম অলিন্দে আসে
  5. বাম নিলয় রক্তকে এওরটার মাধ্যমে সারা শরীরে পাঠায়

৫.২ রক্তনালী

ইলিশের রক্তনালী সিস্টেম জটিল ও সুসংগঠিত:

  1. ধমনী:
    • অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত বহন করে
    • প্রধান ধমনী: ডরসাল এওরটা
    • শাখা-প্রশাখা: বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহ করে
  2. শিরা:
    • অক্সিজেন-বিহীন রক্ত বহন করে
    • প্রধান শিরা: পোস্টিরিয়র কার্ডিনাল ভেইন
    • বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে হৃৎপিণ্ডে ফেরত আনে
  3. কোশিকা:
    • অত্যন্ত সূক্ষ্ম রক্তনালী
    • ধমনী ও শিরার মধ্যবর্তী সংযোগ স্থাপন করে
    • কোষে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে

৫.৩ রক্ত

ইলিশ মাছের রক্তের বৈশিষ্ট্য:

  • রং: লাল (হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির কারণে)
  • উপাদান: প্লাজমা, লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা
  • বিশেষত্ব: তাপমাত্রার সাথে পরিবর্তনশীল (পয়কিলোথার্মিক)

রক্তের কাজ:

  1. অক্সিজেন বহন
  2. পুষ্টি উপাদান পরিবহন
  3. বর্জ্য পদার্থ অপসারণ
  4. রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সহায়তা
  5. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা

ইলিশের রক্ত সংবহন তন্ত্র তাদের জলজ জীবনের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া, যা তাদেরকে বিভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

৬. স্নায়ুতন্ত্র

ইলিশ মাছের স্নায়ুতন্ত্র তাদের শারীরিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য দায়ী।

৬.১ মস্তিষ্ক

ইলিশের মস্তিষ্ক ছোট কিন্তু জটিল:

  • অবস্থান: মাথার খুলির ভিতরে
  • আকার: শরীরের তুলনায় ছোট (প্রায় ০.৪% – ০.৮%)
  • প্রধান অংশ: অগ্রমস্তিষ্ক, মধ্যমস্তিষ্ক, পশ্চাৎমস্তিষ্ক

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজ:

  1. অগ্রমস্তিষ্ক: গন্ধ অনুভূতি, স্মৃতি, শিক্ষণ
  2. মধ্যমস্তিষ্ক: দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রক্রিয়াকরণ
  3. পশ্চাৎমস্তিষ্ক: ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ, পেশী সমন্বয়

৬.২ সুষুম্নাকাণ্ড

  • অবস্থান: মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে প্রসারিত
  • কাজ: মস্তিষ্ক ও শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন

৬.৩ স্নায়ু

ইলিশের শরীরে বিভিন্ন ধরনের স্নায়ু রয়েছে:

  1. সংবেদী স্নায়ু: পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মস্তিষ্কে পাঠায়
  2. মোটর স্নায়ু: মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ পেশীতে বহন করে
  3. মিশ্র স্নায়ু: উভয় ধরনের কাজ করে

৬.৪ বিশেষ সংবেদী অঙ্গ

  1. গন্ধ গ্রাহক: নাসারন্ধ্রে অবস্থিত, খাদ্য ও বিপদ সনাক্তকরণে সাহায্য করে
  2. স্বাদ কুঁড়ি: জিহ্বা ও মুখগহ্বরে অবস্থিত, খাদ্যের স্বাদ অনুভব করে
  3. শ্রবণ যন্ত্র: অভ্যন্তরীণ কানে অবস্থিত, জলের কম্পন অনুভব করে

ইলিশের এই জটিল স্নায়ুতন্ত্র তাদেরকে পরিবেশের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

৭. শ্বাসতন্ত্র

ইলিশ মাছের শ্বাসতন্ত্র জলের মধ্য থেকে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশনের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত।

৭.১ ফুলকা

ফুলকা ইলিশের প্রধান শ্বাস অঙ্গ:

  • সংখ্যা: ৪ জোড়া
  • অবস্থান: মাথার দুই পাশে
  • গঠন: অসংখ্য সূক্ষ্ম রক্তনালীযুক্ত পাতলা পর্দা

ফুলকার কার্যপ্রণালী:

  1. ইলিশ মুখ খুলে জল গ্রহণ করে
  2. জল ফুলকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়
  3. ফুলকার পর্দায় থাকা রক্তকণিকা জল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে
  4. কার্বন ডাই-অক্সাইড রক্ত থেকে জলে মিশে যায়
  5. ব্যবহৃত জল ফুলকার পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়

৭.২ ফুলকা ঢাকনা

  • নাম: অপারকুলাম
  • অবস্থান: ফুলকার বাইরের দিকে
  • কাজ: ফুলকাকে সুরক্ষা প্রদান ও জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ

৭.৩ সাঁতরণ থলি

  • অবস্থান: শরীরের অভ্যন্তরে, পাকস্থলীর উপরে
  • কাজ: ভাসমানতা নিয়ন্ত্রণ ও শব্দ উৎপাদন

সাঁতরণ থলির বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  1. গ্যাস পূর্ণ: মূলত অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন থাকে
  2. আকার পরিবর্তনশীল: পানির গভীরতা অনুযায়ী সংকুচিত বা প্রসারিত হয়
  3. দুই কক্ষবিশিষ্ট: সামনের ও পিছনের কক্ষ

ইলিশের এই বিশেষ শ্বাসতন্ত্র তাদেরকে বিভিন্ন গভীরতায় ও বিভিন্ন লবণাক্ততার পানিতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সক্ষম করে।

৮. পরিপাক তন্ত্র

ইলিশ মাছের পরিপাক তন্ত্র তাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিশেষভাবে অভিযোজিত।

৮.১ মুখ ও দাঁত

  • মুখের আকৃতি: ছোট ও উপরমুখী
  • দাঁত: খুব ছোট বা অনুপস্থিত
  • বিশেষ বৈশিষ্ট্য: মুখ প্রসারণযোগ্য, যা বড় আকারের খাবার গিলতে সাহায্য করে

৮.২ গলবিল

  • সংখ্যা: ১০০-২৫০টি
  • অবস্থান: ফুলকার ভিতरের দিকে
  • কাজ: প্লাংকটন ধরার জন্য ফিল্টার হিসেবে কাজ করে

৮.৩ খাদ্যনালী

  • দৈর্ঘ্য: শরীরের দৈর্ঘ্যের প্রায় ১.৫ গুণ
  • বিভাগ: গ্রাসনালী, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র

৮.৪ পাকস্থলী

  • আকার: মাঝারি
  • বিশেষত্ব: পাকস্থলীর পিলোরিক সিকা (১২-৩০টি)
  • কাজ: খাদ্য হজম ও পুষ্টি শোষণ

৮.৫ যকৃত

  • অবস্থান: পাকস্থলীর কাছে
  • কাজ: পিত্তরস উৎপাদন, প্রোটিন সংশ্লেষণ, বিষাক্ত পদার্থ নিষ্কাশন

৮.৬ অগ্ন্যাশয়

  • অবস্থান: পাকস্থলীর কাছে
  • কাজ: পাচক রস উৎপাদন, ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণ

ইলিশের পরিপাক তন্ত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  1. গলবিল প্লাংকটন ধরার জন্য বিশেষভাবე অভিযোজিত
  2. পাকস্থলীর পিলোরিক সিকা খাদ্য হজমের ক্ষেত্রফল বাড়ায়
  3. যকৃত ও অগ্ন্যাশয় একসাথে কাজ করে খাদ্য হজমে সাহায্য করে

এই জটিল পরিপাক তন্ত্র ইলিশকে বিভিন্ন ধরনের খাবার (যেমন প্লাংকটন, ছোট মাছ, শৈবাল) হজম করতে সক্ষম করে।

৯. প্রজনন তন্ত্র

ইলিশ মাছের প্রজনন তন্ত্র তাদের অভিবাসী জীবনচক্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৯.১ পুরুষ ইলিশ

  1. শুক্রাশয়:
    • সংখ্যা: ২টি
    • অবস্থান: শরীরের পেছনের দিকে
    • কাজ: শুক্রাণু উৎপাদন ও সংরক্ষণ
  2. শুক্রনালী:
    • শুক্রাশয় থেকে বাইরে শুক্রাণু নিঃসরণের পথ

৯.২ স্ত্রী ইলিশ

  1. ডিম্বাশয়:
    • সংখ্যা: ২টি
    • অবস্থান: শরীরের পেছনের দিকে
    • কাজ: ডিম উৎপাদন ও সংরক্ষণ
  2. ডিম্বনালী:
    • ডিম্বাশয় থেকে বাইরে ডিম নিঃসরণের পথ

প্রজনন তন্ত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  1. মৌসুমি পরিবর্তন: প্রজনন মৌসুমে প্রজনন অঙ্গ বড় হয়ে যায়
  2. উচ্চ উৎপাদনশীলতা: একটি স্ত্রী ইলিশ প্রায় ১০-১৫ লাখ ডিম পাড়তে পারে
  3. বাহ্যিক নিষেচন: জলের মধ্যে ডিম ও শুক্রাণু মিলিত হয়

১০. ইলিশের বিশেষ অভিযোজন

ইলিশ মাছের শারীরিক গঠন তাদের জীবনধারণের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত:

  1. হাইড্রোডাইনামিক আকৃতি: চ্যাপ্টা ও সুডৌল শরীর জলের প্রতিরোধ কমায়
  2. রূপালি রং: জলের নিচে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে
  3. শক্তিশালী পেশী: দীর্ঘ অভিবাসনে সহায়তা করে
  4. উন্নত ইন্দ্রিয়: পার্শ্বরেখা ও চোখ জলের নিচে ভালভাবে অনুভব করতে সাহায্য করে
  5. লবণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা: মিঠা ও লবণাক্ত পানি উভয় পরিবেশে বাঁচতে সক্ষম করে
  6. উচ্চ প্রজনন ক্ষমতা: প্রজাতির টিকে থাকা নিশ্চিত করে

প্রশ্নোত্তর (FAQ)

প্রশ্ন: ইলিশ মাছের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী?

উত্তর: ইলিশের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তার অভিবাসী স্বভাব। এটি সমুদ্র থেকে নদীতে প্রজননের জন্য যাতায়াত করে, যা তার শারীরিক গঠনে প্রতিফলিত হয়।

প্রশ্ন: ইলিশ কীভাবে মিঠা ও লবণাক্ত পানি উভয় পরিবেশে বাঁচতে পারে?

উত্তর: ইলিশের শরীরে বিশেষ অসমোরেগুলেটরি ব্যবস্থা রয়েছে, যা শরীরের লবণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া, তাদের ফুলকা ও বৃক্ক বিভিন্ন লবণাক্ততায় কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।

প্রশ্ন: ইলিশ মাছের এত আঁশ কেন থাকে?

উত্তর: ইলিশের অসংখ্য আঁশ তাদের শরীরকে নমনীয়তা প্রদান করে, যা দ্রুত সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। এছাড়া, আঁশ শরীরকে বাহ্যিক আঘাত থেকে রক্ষা করে ও জলের প্রতিরোধ কমায়।

প্রশ্ন: ইলিশ কী খায়?

উত্তর: ইলিশ মূলত প্লাংকটন, ছোট মাছ, ও শৈবাল খায়। তাদের গলবিল প্লাংকটন ধরার জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত।

প্রশ্ন: ইলিশের চোখ কি বিশেষ?

উত্তর: হ্যাঁ, ইলিশের চোখ বড় ও উজ্জ্বল, যা তাদেরকে কম আলোতেও ভালো দেখতে সাহায্য করে। এছাড়া, তাদের চোখ রঙ দেখতে সক্ষম, যা খাদ্য ও শিকারী সনাক্ত করতে সাহায্য করে।

উপসংহার

ইলিশ মাছের শারীরিক গঠন তার জীবনচক্র ও পরিবেশের সাথে অসাধারণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ – তার চ্যাপ্টা দেহ থেকে শুরু করে জটিল পার্শ্বরেখা পর্যন্ত – ইলিশকে তার অনন্য জীবনযাপনে সহায়তা করে। এই অসাধারণ মাছটি শুধু বাংলাদেশের জাতীয় মাছই নয়, বরং জৈব বৈচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন। ইলিশের শারীরিক গঠন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যত বাড়বে, ততই আমরা এই মূল্যবান প্রজাতিটিকে সংরক্ষণ ও রক্ষা করার গুরুত্ব উপলব্ধি করব।

ইলিশ মাছ প্রকৃতির এক অসাধারণ সৃষ্টি, যার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার টিকে থাকার সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মাছটির শারীরিক গঠনের মধ্যে লুকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাস, যা আমাদের প্রকৃতির জটিলতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button