মাছের ক্ষত রোগের ঔষধ
প্রাণীজীবী সম্পদ হিসেবে মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মাছ চাষ একটি বিশেষ অবস্থান দখল করে আছে। তবে মাছ চাষে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের আক্রমণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছে ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব একটি তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা।
এই ক্ষত রোগকে ইপিজুটিক আলসারেটিভ সিনড্রোম নামে অভিহিত করা হয়। রোগটি প্রধানত শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইম, কৈ, মেনি, মৃগেল, কার্পিও এবং পুকুরের তলদেশবাসী অন্যান্য মাছ প্রজাতিকে আক্রান্ত করে থাকে। অশুভ পরিবেশগত পরিস্থিতি, দূষিত পানি এবং অপুষ্টিকর খাদ্য এ রোগের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত।
রোগটি বেশ দ্রুত সংক্রামক এবং ক্ষতিকর। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই এর চিকিৎসা প্রয়োজন। বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক, মাছ খাদ্য সমৃদ্ধকরণ এবং জলাশয়ের পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একই সাথে মাছ চাষীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও এই সমস্যা মোকাবিলা করা যায়।
মাছের ক্ষত রোগের লক্ষণ
- আক্রান্ত স্থানে তুলার মত সাদা পদার্থ জমা হয়
- লেজ ও পাখনায় সাদা দাগ সৃষ্টি হয়
- লেজ ও পাখনার পচন ধরে এবং ক্ষয় ধরে
- মাছ দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং রোগ দেখা দেয়ার ২-৩ দিনের মধ্যে ব্যাপক হারে মাছ মারা যায়
- প্রথমে মাছের গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যায়
- লাল দাগের স্থানে ঘা ও ক্ষত তৈরি হয়
- ক্ষতে চাপ দিলে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হয়
- লেজের অংশ খসে পড়ে
শীতকালে মাছ চাষে এই ক্ষতরোগটি বেশি আক্রমণ করে থাকে।
মাছের ক্ষত রোগের পরিচিতি
এফানোমাইসেস ছত্রাক পোড়া ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উক্ত রোগটি সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৩২ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছে এই রোগ দেখা যায়। যেমন: টাকি, শোল, পুঁটি, বাইম, কৈ, শিং, মৃগেল, কাতল সহ বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছে।
মাছের ক্ষত রোগের প্রতিকার
বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করলে মাছের ক্ষতরোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। শীতকালে পুকুরের পানি কমে যাওয়া, পানি দূষিত হওয়া এবং মাছের রোগবালাই বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই এ সময় বিশেষভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
চিকিৎসা নির্দেশনা:
১. আক্রান্ত মাছকে লবণজল গোসলের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। এজন্য ০.৫%, ১% অথবা ২% লবণ মিশ্রিত পানিতে মাছকে ২০-২৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। মাছ যতক্ষণ সহ্য করতে পারবে ততক্ষণই ডুবিয়ে রাখা যাবে। এটি ভাল ফলাফল দেয়।
২. অক্সিটেট্রাসাইক্লিন বা সালফা গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক মাছের খাদ্যে মিশিয়ে খাওয়ানো যায়। প্রতি কেজি খাদ্যে ৫০-৭৫ মিলিগ্রাম অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অথবা ১০০-১২৫ মিলিগ্রাম সালফা জাতীয় ওষুধ মিশিয়ে ৭ দিন ধরে খাওয়ানো যেতে পারে।
৩. আক্রান্ত ব্রুড মাছের ক্ষেত্রে, প্রতি কেজি দেহভরের হিসাবে ১০০ মিলিগ্রাম হারে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন প্রয়োগ করা যায়।
প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা:
- পুকুরের পানির গুণগত মান বজায় রাখা এবং প্রয়োজনে পানি পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি।
- রোগাক্রান্ত মাছকে সুস্থ মাছ থেকে আলাদা করে রাখতে হবে।
- মাছের খাদ্য ও পরিচর্যার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- পুকুরে মাছের ঘনত্ব কমিয়ে রাখা উচিত।
- শীতকালে পুকুরের যথেষ্ট গভীরতা বজায় রাখতে হবে।
এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মাছের ক্ষতরোগের প্রকোপ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
আমাদের দেশের যেসব রোগে মাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে
ক্ষত রোগ
আমাদের দেশে সাধারণত শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইম, কৈ, মৃগেল, কার্পিও এবং পুকুরের তলায় বসবাসকারী অন্যান্য প্রজাতির মাছ ক্ষত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
মাছের ক্ষত রোগের লক্ষণ
- মাছের গায়ে ক্ষত বা ঘাজনিত লাল দাগ দেখা যায়
- এই দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে
- ঘা মাছের লেজের গোড়া, পিঠ ও মুখের দিকেই বেশি হয়
ক্ষত রোগের প্রতিকার
- রোগাক্রান্ত মাছকে পুকুর থেকে দ্রুত তুলে ফেলতে হবে
- লবণজলে (10 লিটার পানিতে 100 গ্রাম লবণ) 5-10 মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে
- প্রতিবছর আশ্বিন/কার্তিকে পুকুরে চুন ও লবণ প্রয়োগ করতে হবে
পেট ফোলা রোগ
রুই, শিং-মাগুর ও পাঙ্গাশ মাছ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
লক্ষণ:
- দেহের রং ফ্যাকাশে হওয়া
- পেটে পানি জমে পেট ফুলে থাকা
- ভারহীন চলাফেরা ও পানির ওপর ভাসা
প্রতিকার:
- পুকুরে চুন প্রয়োগ
- খাদ্যে ফিশমিল ব্যবহার
- পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ
পাখনা ও লেজ পচা রোগ
রুই, শিং-মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ:
- প্রথমে পিঠের পাখনা আক্রান্ত হয়
- ক্রমে অন্যান্য পাখনাও আক্রান্ত হয়
প্রতিকার:
- পটাশযুক্ত পানিতে 3-5 মিনিট ডুবানো
- সার প্রয়োগ বন্ধ করা
- মাছের সংখ্যা কমানো
- পুকুরে চুন প্রয়োগ
উকুন রোগ
রুই ও কাতল মাছে প্রধানত এই রোগ দেখা যায়।
লক্ষণ:
- গায়ে উকুন ছড়িয়ে পড়া
- দেহরস শোষণ ও ক্ষতবিক্ষত হওয়া
প্রতিকার:
- লবণজলে ডুবিয়ে রাখা
- মাছের গা থেকে উকুন তুলে ফেলা
পুষ্টির অভাব
যেকোনো মাছে এই সমস্যা দেখা যেতে পারে।
লক্ষণ:
- অন্ধত্ব ও হাড় বাঁকা হওয়া
- স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় বাধাপ্রাপ্তি
প্রতিকার:
- খাদ্যে ভিটামিন ও খনিজ প্রয়োগ
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষে এসব রোগ প্রতিরোধ করা অনেকাংশে সম্ভব।
মাছের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার
রোগের নাম | চিকিৎসা |
---|---|
ক্ষত রোগ | – আক্রান্ত মাছ পুকুর থেকে তুলে নেওয়া
– ৫-১০ মিনিট লবণজলে (১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম লবণ) ডুবানো – শীতকালের আগে বাৎসরিকভাবে পুকুরে চুন ও লবণ প্রয়োগ করা |
পেট ফোলা রোগ | – পুকুরে চুন প্রয়োগ করা
– খাদ্যে ফিশমিল ব্যবহার করা – যথেষ্ট প্রাকৃতিক ও সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করা |
পাখনা ও লেজ পচা রোগ | – ৩-৫ মিনিট পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে ডুবানো
– সাময়িকভাবে সার প্রয়োগ বন্ধ করা – মাছের ঘনত্ব কমিয়ে আনা – পুকুরে চুন প্রয়োগ করা |
উকুন রোগ | – ২.৫% লবণ দ্রবণে ডুবানো
– মাছের গা থেকে হাতে উকুন সরিয়ে ফেলা |
পুষ্টির অভাব | – খাদ্যে ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো |
প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি হল
- লবণজলে ডুবানো
- পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে ডুবানো
- পুকুরে চুন প্রয়োগ
- খাদ্যে সম্পূরক (ফিশমিল, ভিটামিন, খনিজ) যোগ করা
- মাছের ঘনত্ব কমানো
- সাময়িকভাবে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখা
- হাতে পরজীবী সরিয়ে ফেলা
পানির গুণগত মান বজায় রাখা এবং পুকুর পরিচর্যার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করাও মাছের রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।