মানুষের খাদ্যাভ্যাস অনেকটাই স্থির। কিন্তু মাছের খাদ্যাভ্যাস অনেক বেশি গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল। মাছরা নানান ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তাদের খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে বসবাসের পরিবেশ, প্রজাতি এবং বয়সের উপর। কিছু মাছ শুধুমাত্র প্রাণিজ খাদ্য, কিছু শুধু উদ্ভিদ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। আবার অনেক মাছই উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণ করে।
মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের ধরনের উপর ভিত্তি করেই মাছচাষে খাদ্য নির্বাচন করা হয়। মাছচাষের জন্য উপযুক্ত খাদ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন জেনে নেওয়া যাক মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য কী কী এবং কীভাবে তারা নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে।
মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য কাকে বলে?
বর্তমান যুগে মাছচাষের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি অনেক বেশি হয়েছে। তবে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও অপরিপূর্ণ। প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছরা কী খায়? কীভাবে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আজকের এই আলোচনা।
প্রাণিজ প্রাকৃতিক খাদ্য:
অনেক মাছই প্রাণিজ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তাদের প্রাকৃতিক প্রাণিজ খাদ্যের মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের প্রাণী যেমন:
ক্ষুদ্র শিকার: ক্ষুদ্র মাছ, চিংড়ি ইত্যাদি অনেক মাছের প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে গণ্য। বিশেষ করে গ্রাসি মাছগুলো অনেক বেশি ক্ষুদ্র শিকারের উপর নির্ভরশীল।
প্রাণী প্লাংকটন: এগুলো ক্ষুদ্রাকার প্রাণী যা জলাশয়ে ভেসে থাকে। যেমন ডাফনিয়া, সাইক্লোপস, রোটিফার, কপেপড ইত্যাদি। মাছের বাচ্চাদের জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস।
জলজ কীটপতঙ্গ: নদী-খাল, জলাশয়ে বসবাসকারী বিভিন্ন কীটপতঙ্গ যেমন মশা লার্ভা, জলগোলাপ মাছের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে গণ্য।
খাবারের অবশিষ্টাংশ: বিভিন্ন জলজ প্রাণী যেমন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের মল বা অন্যান্য খাবারের অবশিষ্টাংশ অনেক মাছের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে ডেট্রাইটিস খাওয়া মাছগুলোর ক্ষেত্রে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
উদ্ভিদ প্রাকৃতিক খাদ্য:
উদ্ভিদজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে এমন মাছেরাও রয়েছে বহু। তাদের প্রাকৃতিক খাদ্যের মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের উদ্ভিদ প্লাংকটন, শৈবাল ও অন্যান্য উদ্ভিদ যেমন:
ফাইটোপ্লাংকটন: এগুলো হল ক্ষুদ্রাকার শৈবাল যা জলাশয়ে ভেসে থাকে। যেমন চ্লোরেলা, মিরাসাইরিস, সাইনোবেকটেরিয়া। অনেক মাছেরই এগুলো প্রাথমিক খাদ্য।
নৈসর্গিক শৈবাল: প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে নানা ধরনের শৈবাল জন্মায়। যেমন- স্পাইরোগাইরা, ওজিলাটোরিয়া, নাইটেলা ইত্যাদি। এগুলো বেশ কিছু মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য।
তৃণজাতীয় উদ্ভিদ: নদীর তীরবর্তী এলাকায় জন্মানো নানা ধরনের তৃণ যেমন- ঘাস, খাগড়াখেকশি, শালুক ইত্যাদি অনেক মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য।
ফলমূল: জলাশয়ে পড়ে গিয়ে নষ্ট হওয়া বিভিন্ন ফল, মূল এবং তার অংশবিশেষ যেমন ডাল, পাতা ইত্যাদি অনেক মাছের খাদ্য হয়ে থাকে।
মাছদের খাদ্য সংগ্রহ প্রণালী:
মাছদের খাদ্য সংগ্রহের প্রণালী খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাদের প্রজাতি এবং খাদ্যের ধরনের উপর নির্ভর করে খাদ্য সংগ্রহ প্রণালী পাল্টে যায়। কিছু প্রচলিত খাদ্য সংগ্রহ প্রণালীর বিবরণ নিম্নরূপ:
শিকার: গ্রাসি মাছগুলো অন্যান্য ক্ষুদ্র মাছ, চিংড়ি প্রভৃতি শিকার করে খায়। এদের মুখগহ্বর বড় এবং তীক্ষ্ণ দাঁত থাকে। শক্তিশালী পাখনা দিয়ে এরা দ্রুত সাঁতার কাটে এবং শিকার ধরতে পারে।
ছেঁকে খাওয়া: কিছু মাছ সামনে থাকা খাদ্যগুলো ছেঁকে মুখের মধ্যে টেনে নেয়। এদের মুখগহ্বর বড় এবং কর্কশ। যেমন কার্প, রুই মাছ।
গিলে নেওয়া: ছোট মাছ যেমন মৌলা বা খাদ্য কণিকাগুলোকে শুষে/গিলে নিয়ে খায়। এদের মুখগহ্বর ছোট তবে উচ্চ শোষণক্ষমতা আছে।
ছিদ্র দিয়ে শুষে নেওয়া: নলকূটজাতীয় মাছ যেমন গাঙ্গু মাছের মুখগহ্বর চোঙাকৃতি এবং পেটের নিচে ছিদ্র থাকে। এদের এই ছিদ্র দিয়ে খাদ্য কণিকাগুলো শুষে নেওয়ার ক্ষমতা আছে।
চয়ন করে খাওয়া: কিছু মাছ প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা বিভিন্ন খাদ্যকণা থেকে তাদের প্রিয় খাদ্যটিই বেছে নেয় এবং গ্রহণ করে। যেমন টাইলাপিয়া মাছগুলো শুধু তাদের প্রিয় উদ্ভিদ খাদ্যই খাওয়ার চেষ্টা করে।
মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব:
মাছের খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব তার শরীরের গঠন এবং স্বাস্থ্যের উপর পড়ে। বিভিন্ন খাদ্য গ্রহণের ফলে শরীরে ভিন্ন ভিন্ন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হয়। শরীরে শক্তি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মাছের প্রজনন প্রক্রিয়াও খাদ্যাভ্যাসের উপর নির্ভরশীল।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে মানুষের জন্য মাছ উপযোগী করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ- গ্রাসি মাছদের শাকাহারি করে উচ্চ মানের প্রোটিন সমৃদ্ধ করা যায়।
তাই মাছচাষের ক্ষেত্রে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং গবেষণা খুবই জরুরি।
প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছের জন্য কোন ধরনের খাদ্য উপলব্ধ থাকবে তা জ্ঞাত হলে মাছচাষে সেই অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করা সহজ হবে। ফলে মাছের বিকাশ সুষ্ঠু হবে এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
এছাড়াও প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছদের খাদ্য সরবরাহ প্রণালী নির্বাচন করা সহজ হবে। যা মাছের মানসিক স্বাস্থ্য ও আচরণ বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্রায়োগিক উদাহরণ:
ইলিশ মাছ পোনা অবস্থায় প্রাণী প্লাংকটনের উপর নির্ভরশীল। ইলিশের পোনা সরবরাহের ক্ষেত্রে তাই এই বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। প্রাণী প্লাংকটনের চাষ করা হয় এবং তা পোনা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আবার রুই মাছের পোনা মূলত প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে ক্ষুদ্র শিকারের উপর নির্ভরশীল। তাই এদের ক্ষুদ্র মাছ/প্রাণীজীব খাওয়ানো হয়।
বিভিন্ন পর্যায়ের মাছদের খাদ্য ও খাদ্যগ্রহণ প্রণালী সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। ভারতীয় রুপচাندা প্রথম অবস্থায় শৈবাল খেয়ে বেড়ে ওঠে। পরবর্তী কিশোর অবস্থায় ক্রমশ প্লাংকটনিক খাদ্য খেতে থাকে। আবার প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পুরোপুরি মাংসাশী অর্থাৎ শিকারপ্রিয় হয়ে যায়।
এভাবে নানান ধরনের মাছের নানা পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে যা অনেকাংশেই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফল। সুতরাং মাছচাষে প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
FAQ (প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী):
মাছগুলো কিভাবে খাদ্য খুঁজে পায়?
মাছগুলোর নাক এবং চোখের গঠন এমন যে তারা দূরত্ব থেকে খাদ্যের গন্ধ আর আভা উপলব্ধি করতে পারে। কিছু কিছু মাছের গায়ে থাকা রোম দিয়ে তারা বিভিন্ন কম্পন উপলব্ধি করে খাদ্য খুঁজে পায়।
পুষ্টিগুণে ভরপুর মাছ পেতে কোন ধরনের খাদ্য সবচেয়ে ভালো?
মাংসাশী মাছগুলোর মাংস পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হয়। তাই মাংসাশী খাদ্য যেমন প্রাণীজাত খাদ্য তাদেরকে খাওয়ালে মাছগুলো পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হবে।
মাছের খাদ্যাভ্যাস কিভাবে তাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে?
মাছের বিকাশ, বৃদ্ধি এবং প্রজনন ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করে তাদের খাদ্যাভ্যাসের উপর। পুষ্টিহীন খাদ্য গ্রহণ করলে মাছদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিপরীতক্রমে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে তারা সুস্থ এবং সক্রিয় থাকে।
উপসংহার:
মাছচাষ এখন বিশ্বব্যাপী এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য শিল্প। মাছচাষে সাফল্য মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এটি জানতে পারলে মাছচাষের সুযোগ সুবিধা গুরুত্বপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাবে।
মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে গবেষণা এবং জ্ঞানচর্চা প্রয়োজন। কারণ এ জ্ঞান মাছচাষের মান এবং ফলনের উন্নতিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসের প্রতিকৃতি পদ্ধতি অনুসরণ করে মাছচাষে উত্তম মানের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।